News/Archive

দশ বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রশিকা

Published: 17-Mar-2023


তরিকুল ইসলাম সুমন
সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

ভঙ্গুরদশা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র। ২০১৫ সালের ঋণ স্থিতি ছিল ৮০ কোটি টাকা যা এখন প্রায় ১২শ কোটি টাকায় এসে পৌঁছেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্ধ থাকা অফিসগুলো চালু করা হয়েছে। সুবিধাভোগী তৃণমূলের মানুষদের ভীতি কাটিয়ে তাদের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেখানে বছরের পর বছর বেতন বন্ধ থাকত, এখন সেখানে নিয়মিত বেতন হচ্ছে, চলছে নতুন জনবল নিয়োগ কার্যক্রম। এমনটাই জানিয়েছেন প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের বর্তমান প্রধান নির্বাহী সিরাজুল ইসলাম।

সম্প্রতি প্রশিকার লিয়াজোঁ অফিসে এক আলাপচারিতায় এসব কথা তিনি বলেন।

সিরাজুল ইসলাম জানান, ২০০৮ সালে প্রশিকার প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. কাজী ফারুক আহম্মদ রাজনৈতিক সংশিষ্টতা এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে প্রশিকার সর্বস্তরের কর্মীদের অসন্তোষের শিকার হন। এই অস্থিরতার সময়ে প্রশিকা চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, শুরু হয় অস্তিত্ব সংকট। প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার জন্য তৎকালীন গভার্নিং বডি প্রশিকার চেয়ারম্যান পদ থেকে কাজী ফারুক আহম্মদকে অপসারণ করে। এই অপসারণ প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে তিনি আদালতে আশ্রয় নেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল বিভক্তি এবং আমাদের ওপর নেমে আসে ড. কাজী ফারুক ও তার অনুসারীদের মাধ্যমে নানান ধরনের মিথ্যা মামলা ও হামলা। সেই সময় এমন কোনো কেন্দ্রীয় কর্মী নাই যার বিরুদ্ধে মামলা ও হামলা করা হয়নি। এ ধারা এখনও চলমান। কিন্তু কর্মী ব্যবস্থাপকদের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে সারা দেশে প্রশিকার বিভিন্ন অফিসগুলো চালু করা হয়েছে। তবে ২০০৮-২০১৪ সাল পর্যন্ত সময় ছিল প্রশিকার জন্য ক্রান্তি কাল। এখন আমরা সারা বাংলাদেশে ২১৬টি অফিস, ৩৩৮টি শাখা অফিসের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করছি। কর্মরত কর্মী-ব্যবস্থাপকগণ নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন, কেন্দ্র ও বিভিন্ন এলাকার অফিসগুলোতে নিয়মিত অডিট হচ্ছে, এমনকি অবসরে যাওয়া কর্মীদেরও পর্যায়ক্রমে প্রভিডেন্ট ফান্ডের বকেয়া টাকা দেয়া হচ্ছে। এসময় পর্যন্ত আমরা প্রায় ৮ কোটি টাকা বকেয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পরিশোধ করেছি। এখনো প্রায় ২ শতাধিক আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এগুলোও পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।


প্রশিকার কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা আমাদের কাজ সারাদেশে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই সকল গঠনমূলক কাজের পদক্ষেপ একটি বিশেষ মহল দ্বারা বার বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের সকল কাজে একটি বিশেষ মহল বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। এত কিছুর পরেও আমরা নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। আমাদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পরিচালনায় সুবিধাভোগীদের গচ্ছিত আমানতের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সকল প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন প্রাপ্তির পরেও বৈদেশিক অনুদান পাওয়া যাচ্ছে না প্রশিকার নামে কিছু মামলা থাকার কারণে। বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনায় আমরা কিছুটা আর্থিক সমস্যার মধ্যে রয়েছি। একাধিক হয়রানিমূলক মামলা থাকার কারণে সরকারি অথবা বৈদেশিক অনুদানে পরিচালনা করা যায় এমন প্রকল্প পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে প্রশিকার নামে থাকা জমি বিক্রির অপচেষ্টা। একাজ করছেন প্রাক্তন চেয়ারম্যান কাজী ফারুক নিয়ন্ত্রিত একটি মহল। প্রশিকার স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি এই অপকর্ম রোধ করতেও আমাদের প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।

ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের কামতা উন্নয়ন এলাকা পরিদর্শনকালে উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলাম শাহীন জানান, তার এই অফিসে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৩৮৫৪ জন। এসব সুবিধাভোগী একদিকে নিজেরা নিজেদের মতো করে এই অফিসে সাপ্তাহিক সঞ্চয় জমা করেন। কেউ আবার ফিক্সড ডিপোজিট, কেউ বিশেষ আমানত জমা রাখেন। ব্যবসা সম্প্রসারণ বা অন্যান্য জরুরী প্রয়োজনের জন্য সমিতিভূক্ত সদস্যরা ঋণের জন্য আবেদন করলে যাচাই বাছাইয়ের পর ঋণ সুবিধা মঞ্জুর করা হয়। এই টাকা দিয়ে তারা যে ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকা- করতে চান, সে বিষয়ে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয়। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে যদি কেউ ঋণের টাকা ফেরত দিতে অপারগ হন, সেক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে মানবিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রয়োজন হলে পুনরায় ঋণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

তিনি আরো বলেন, কামতা উন্নয়ন এলাকার ঋণ স্থিতি প্রায় ১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুবিধাভোগীর আমানত প্রায় ১৩ কোটি টাকা। বাকি টাকা প্রশিকার নিজস্ব। ঋণ রিকভারি প্রায় শতভাগের কাছাকাছি।

সরেজমিন কামতা মধ্যপাড়া মহিলা সমিতির উঠান বৈঠকে গিয়ে দেখা গেছে, উঠানে পাটি পেতে বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন সমিতিভুক্ত সদস্যরা। তারা নিজেদের মধ্যে সুখ দু:খের আলাপ করছেন। কাছে যেতেই তাদের কথা থেমে যায়।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সমিতির সভানেত্রী রওশন আরা (৫০) জানান, প্রশিকা এখন আস্থার প্রতীক। তাদের সমিতির সদস্য সংখ্যা ৫৪ জন। ৯০ ভাগ সদস্য নারী। প্রশিকার আভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের বিষয়টি তারা জানেন। প্রশিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই। তাদের এই অফিসটি কখনো বন্ধ হয়নি। তিনি ২৫ বছর ধরে এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। নিজে ১৯ বার ঋণ নিয়েছেন। বর্তমানে সমিতিতে তার জামানত রয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ঋণ চলছে ৩ লাখ টাকার। প্রতিমাসে তাকে ১৫ হাজর ৯শ টাকা কিস্তি ফেরত দিতে হয়। ঋণের টাকায় তিনি এখন স্বাবলম্বী। কিনেছেন দুধের গরু, জমি জিরাত। তৃণমূল পর্যায়ের একজন সফল উদ্যোগক্তার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বেগম রোকেয়া স্বারক পদক।

সুবিধাভোগী শেফালী (৪০) জানান, ১২ বছর ধরে তিনি এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত। ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ধানি জমি কিনেছেন। সমিতিতে তার সাধারণ সঞ্চয় হিসেবে জমা রয়েছে ৪০ হাজার টাকা। প্রশিকা কামতা অফিসে বিশেষ আমানত হিসেবে জমা রয়েছে ৭ লাখ টাকা। স্বামী ঢাকায় চাকরি করেন। এক সন্তান নিয়ে ভালো আছেন তিনি।

রওশন বেগম (৬০) বলেন, তিনি ৩৫ বছর ধরে প্রশিকার সাথে সংশ্লিষ্ট আছেন। যখন যা পারেন তাই সঞ্চয় হিসেবে সমিতিতে জমা রাখেন। কিছুদিন আগে তিনি প্রশিকা থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ছেলে আশরাফুলকে মিক্সার মেশিন কিনে দিয়েছেন। সেই মেশিন দিয়ে আখের রস করে বিক্রি করে নিয়মিত টাকা আয় করেন। প্রশিকা থেকে গৃহিত ঋণের কিস্তির টাকা ফেরত দিতে তার সমস্যা হয় না। তিনি বেশ ভালো আছেন।



 
© 2022 Proshika. All Rights Reserved.